মার্চ ৮, ২০১৯ :
নারী না,আগে মানুষ হতে চাই
পাপিয়া চক্রবর্তী
মার্চ ৮, ২০১৯, ওয়েবডেস্ক:
“নারী” শব্দটা বাজার চলতি সব থেকে আকর্ষনীয় শব্দগুলোর অন্যতম। ঠিক কোথায়,কবে তা এখন আর মনে নেই তবে একটা টেলিছবিতেই প্রথমবার শুনে ছিলাম একটা শব্দবন্ধ,একটি মেয়ে তার মায়ের স্মৃতিচারনা করতে গিয়ে বলছে-“মা বলতো পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠো”।তখন বেশ ছোটই ছিলাম কিন্তু কথাটা মাথায় ঢুকে গেছিলো।”নারী হয়ে ওঠা” মানেটা কি?তারপর আমাদের দেশের তথাকথিত ধারনা অনুযায়ী নারীর একখানা সংজ্ঞা পেলাম।সাধারনভাবে ভারতীয় নারী বলতে বোঝায়,শাড়ি ,কাজল টিপ,এলোচুল(কোমড় না হোক কাঁধ পর্যন্ত),স্বল্পভাষী,মৃদুহাসি,শান্ত চাহনি(শোবার ঘর ছাড়া অন্যত্র),হুড়মুড়দুড় করে চলতে না জানা এমন একটি অবয়ব যাকে নিয়ে পুরুষ স্বপ্ন দেখতে সাহস করে(হ্যাঁ,সাহস করে)।যার আকাশ মুখো আয়ত চোখে হারিয়ে গিয়ে পুরুষ তার শরীর খোঁজে।তাকে নিয়ে কাব্য করে,গল্প লেখে।যে পুরুষের কোন কথায় কখনও না করেনা ,করতেই পারে না এমন।সে-ই ‘নারী’! বয়েস বাড়লে প্রশ্ন বাড়ে।আমারও বাড়লো।নিজেকে প্রশ্ন করলাম আচ্ছা তাহলে যারা এই উপমহাদেশের সব মানুষের চোখে নারীত্বের প্রতীক তাদের এত অবহেলার শিকার হতে হলো কেন?যেমন, সীতা।রাজার দত্তক কন্যা,রাজার ঘরনী এবং অবশ্যই স্বামী অন্ত প্রাণ,স্বামী সোহাগীনি।তার জীবনে সেই স্বামীর হাতেই লাঞ্ছণা এলো কেন?কেন,অগ্নিসূতা,পন্ডিতা পঞ্চস্বামীর ঘরনী দ্রৌপদিকে নিজের আত্বীয় স্বজনদের হাতেই মিনিস্ট্রুয়াল পিরিয়ডে ধর্ষিতা হতে হবে?আজকের ঘটনা নয় এসব।বহুকালের।তাই আবার একটা নারী দিবসে এই কেন গুলোর উত্তর দিতে চাইছি।
যদি বহু প্রাচীনে ফিরে যাই দেখবো নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিকারে যাচ্ছে।যাযাবর গোষ্ঠী জীবনেও নারী পুরুষ সমান পরিশ্রম করেছে।সমস্যা শুরু হলো চাষবাস শিখে গৃহবাসী হওয়ার পর থেকে।নারী তখন শিকার ছেড়ে চাষের কাজ করে,পালিত পশু আর ছেলেপুলে সামলায়।ধীরে ধীরে এসময় থেকেই শ্রমের পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তন ঘটে নারীর শারীরিক ক্ষমতায়।সমাজ বদলে রাজার রাজত্ব আসতে আসতে নারীর স্থান হয়ে গেছে পুরুষের খাগের ডগায়।সেই সময় থেকেই নারীর তুলনা শুরু হলো নদীর সাথে।যুগের পর যুগ কেটে গেছে কিন্তু সামাজিক আরও অনেক বদ্ধমূল ধারনার মতো নারীর আর নতুন কোন ধারনা এই সব সময় পেছন খোঁজা জাতিটা (নেশন অর্থে)আর খুঁজেই পায়নি।বহু নারী এসব ধারনা ফারনাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করে বেঁচেছেন।তথাকথিত পুরুষালী কাজে পুরুষের থেকে বেশী পৌরুষ দেখিয়েছেন।কিন্তু সেসব এখনও এই পুরুষের চোখে খোঁচা মেরে মান্ধাতার ঠাকুরদার আমলের ধারনা ভাঙতে পারেনি।তাই কি সুন্দর করেই না তারা বলেন-“বারো হাত কাপড়েও নারীর হয়না।”আসলে পুরুষ চালিত সমাজ নারীকে স্বাধীনতা দিতে চায়।তাকে মাথায় করে রাখে, কাব্য করে ততক্ষণ যতক্ষণ সে নারীত্বের শর্তে আছে।বাইরে বেরোলেই গেলো গেলো রব।কেননা পুরুষ নারীকে তার অর্জিত ধন ভাবে।তাই দ্রৌপদিকে জুয়োয় পণ রাখা যায়,সীতাকে ত্যাগ করা যায়।
হাজার হাজার শতাব্দী পরও সেই অধিকারবোধ থেকে বেরিয়ে আসেনি পুরুষ।নিজের স্ত্রী,বোন,কন্যার পোষাক নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আসে সে।তার হাঁটাচলা কথাবলা সব নির্ধারণ করতে চায় এখনও।সেই নারীত্বের গন্ডি ছাড়ালেই জোটে বিদ্রুপ,লাঞ্ছণা।তবে এই লাঞ্ছণার শিকার মেয়েরা এমনি এমনিই হয়নি বা হয়না।নিজেরাই নিজেদের পেছনে লাগা,ঈর্ষা করা মেয়েদের স্বভাবে পরিনত হয়েছে।নিজের সব ভালো আর পাশের বাড়ির মেয়েটা জিন্স পড়লে, একটা ছেলের সঙ্গে গল্প করলেই যত্ত দোষ।কোন মেয়ে কেন বিয়ে করেনি,কেন সবার সাথে মেলামেশা করে এসবের খোঁজ ছেলেদের থেকে মেয়েরাই রাখে বেশী।দুই ছেলে মেয়ের মা হওয়ার পর চুড়িদার পরার সুযোগ পাওয়া মেয়েটি ছেলেমেয়ের সামনেই নির্দ্বধায় বলে”ওর বাবা আমাকে খুব স্বাধীনতা দেয়।”আসলে স্বাধীনতা বিষয়টা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনাটুকু এখনও পর্যন্ত গড়েই ওঠেনি বেশীরভাগ মেয়ের। গন্ডী ভাঙ্গার সাহস যারা দেখিয়েছে বা দেখায় তাদের নামে কুৎসা না রটিয়ে পাশে দাঁড়ালেই আজ আর অর্ধেক আকাশের কথা উঠতো না।সকলকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলবো,নারী না ,আগে আমরা মানুষ হই তারপর নাহয় পুরুষের কলমের ডগায় ওঠার কথা ভাবা যাবে।আসুন,এই নারী দিবসে আমরা শপথ নিই নিজেরা নিজেদের পেছনে আর লাগবো না।তাহলেই পুরো আকাশ এসে ধরা দেবে নিজের উঠোনে।