অরবিন্দ ভট্টাচার্য
আগস্ট,৯,২০২০: উত্তরের কুয়াশা ঘেরা ছোট্ট শহরে তখন শীতের শেষ রাত। দূর থেকে অনেক গুলো মানুষের সমবেত চলার শব্দটা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে প্রিয়শঙ্করদের বাড়ির দিকে। বুটের শব্দ। রাতে ঘুম হয় নি। বন্ধুর বৌভাতের নেমন্তন্ন ছিল। অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছে। রাতে গুরুপাক হলে কখনোই প্রিয়র ঘুম আসে না। মাশারী তুলে জানালা দিয়ে ভোরের আবছা আলোয় বাইরে তাকিয়ে দেখে ছায়া মূর্তির মত একদল মানুষ এগিয়ে আসছে তাঁদের বাড়ির দিকে। জানালা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ে প্রিয়শঙ্কর। এবার শব্দটা বড় হতে হতে থেমে যায় ঠিক তাঁদের বাড়ির সামনে এসে । মফ:স্বল শহরে টিনের ছাউনি দেওয়া পাকা বাড়ি। বাইরের কাঠের গেটটা খোলাই থাকে সব সময়। সেটা খুলে কয়েকজন বারান্দায় উঠে আসে। এবার দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। প্রিয়র বাবা বাইরে ছিলেন কাজে। পাশের ঘরে মেয়েদের নিয়ে শুয়ে ছিলেন প্রিয়শঙ্করের মা উমাদেবী। হঠাত্ করে জেগে ওঠেন তিনি। এবার আরো জোরে কড়া নাড়ার শব্দ। কিছুটা আতঙ্কিত স্বরে তিনি বলে ওঠেন, কে, কে আপনারা? বাইরে থেকে কেউ একজন বলে ওঠেন, দরজাটা একটু খুলুন। আমরা থানা থেকে আসছি। ধরপর করে বিছানা থেকে উঠে উমাদেবী দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ান। বাইরে প্রচুর পুলিশ। কিছুটা ভয়ার্ত সুরে উমাদেবী বলে ওঠেন, কি হয়েছে ? আপনারা কেন ? একজন বলে ওঠেন, প্রিয়শঙ্কর ব্যানার্জি আপনার কে হন ? উমাদেবী উত্তর দেন, কেন আমার ছেলে! এবার আবার প্রশ্ন, উনি কি বাড়িতে আছেন ? হ্যাঁ, পাশের ঘরে ঘুমিয়ে আছে, উমাদেবী বলেন। ওকে একটু ডাকুন, বলেন আগন্তুক। পাশের ঘর থেকে প্রিয়শঙ্কর সব কথা শুনতে পাচ্ছিল। একবার ভেবেছিল, বাড়ির পেছন দিকের দেওয়াল টপকে পালিয়ে যাবে। পরক্ষণেই সে ভাবে, কেন পালাবে, সে তো কোন অন্যায় করে নি। শুধু কলেজে পড়ার সময় একটু আধটু রাজনীতি করতো। সটান গিয়ে দাঁড়ায় দরজায়। চারদিকে অসংখ্য পুলিশ। আমার নাম প্রিয়শঙ্কর ব্যানার্জি। বলুন কেন এসেছেন? এক অফিসার বলে ওঠেন, কিছু কথা আছে। আমাদের সাথে আপনার একটু থানায় যেতে হবে। প্রিয়শঙ্কর বলে ওঠে, এত ভোরে কেন আমি থানায় যাবো? কথা শেষ হতেই ওই অফিসার হাত ধরে টেনে নেয় প্রিয়শঙ্করকে। বলেন, “ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট”। বেশি কথা বাড়াবেন না, “ইমারজেন্সী” চলছে। থানায় গেলেই সবকিছু জানতে পারবেন। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে বড় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল কালো পুলিশ ভ্যানটা। প্যান্ট জমা পাল্টে প্রিয়শঙ্কর ওদের সাথে চলে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়ে পুলিশের গাড়ির পেছন পেছন দৌড়তে থাকেন উমাদেবী। ভ্যান থেকে নামিয়ে পুলিশ সোজা লকআপে পুড়ে দেয় প্রিয়শঙ্করকে। তাঁকে কেন, কি জন্য ধরা হয়েছে, বহুবার জানতে চেয়েও উত্তর পায় নি প্রিয়শঙ্কর। লকআপে ঢুকেই মদ আর পেচ্ছাপের উত্কট গন্ধে প্রাণ বেরিয়ে আসছিল প্রিয়শঙ্করের। ভেতরে উদ্ভ্রান্ত চেহারার আর দু তিন জন যারা ছিল, তারা যে যার মতো অনর্গল আবোল তাবোল বকে চলেছিল। রাতের নেশা তখনো কাটে নি ওদের! লোহার গারদ ধরে এক পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়শঙ্কর। দু চোখ ফেটে জল আসছিল। মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
ধীরে ধীরে সকাল হয়ে এলো। নটা নাগাদ বড় বাবু এলেন। এসেই তিনি ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ডিউটি রুমে ডায়াল ঘোরানো মস্ত কালো রঙের টেলিফোন। বড়বাবু বলছেন, “স্যার, রাতে রেড করে একজনকে ধরে আনা হয়েছে। নাম প্রিয়শঙ্কর ব্যানার্জি। আর্সন আর বোম্বিং কেসে মোস্ট ওয়ানন্টেড। নকশাল কানেকসন খোঁজ করে দেখা হচ্ছে”। একটু পরে এক সেন্ট্রি এসে লকআপের দরজা খুলে প্রিয়শঙ্করকে বড় বাবুর চেম্বারে নিয়ে যায়। জাদরেল বড়বাবু ডি॰ কে॰ সিনহা। বললেন, “সকাল থেকে অনেক ফোন এসেছে, দু এক জন নেতাও এসেছিলেন আমার কাছে। আমি জানি তুমি ভাল ছেলে। চিন্তা করো না। কোর্ট থেকে জামিন হয়ে যাবে”। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স গ্র্যাজুয়েট প্রিয়শঙ্কর ততক্ষণে জেনে গেছে, ৪৩৬ সহ যে তিন/চারটি ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে ফরওয়ার্ডিং রিপোর্ট লেখা হয়েছে তার সব গুলোই জামিন অযোগ্য। এবার আদালতে যেতে হবে। রাস্তার পাশের ঝুপড়ি হোটেল থেকে কলাই করা গামলাতে করে তার জন্য যে খাবার আনা হয়েছিল সে দিকে তাকানোর মতো মনের অবস্থা বা রুচি কোনটাই ছিল না প্রিয়শঙ্করের ।
সকাল এগারোটা নাগাদ পুলিশ ভ্যানে সোজা আদালত। গারদের ভেতর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়। গোটা আদালত চত্বর ভাল ছেলে প্রিয়কে দেখতে ভেঙে পড়েছে। আইনজীবিদের মধ্যেও গুঞ্জন। ঠিক দুটোর সময় হাকিম এলেন। পুলিশের রিপোর্টের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে এক ঝলক দেখে নিলেন গারদের আসামিদের। হাকিমের চোখে চোখ পড়তেই দু হাত তুলে তাঁকে নমস্কার জানায় বেচারা প্রিয়শঙ্কর। হাকিম চোখ নামিয়ে নিয়ে খচ খচ করে লিখে গেলেন অনেকক্ষণ। তারপর শুধু বললেন, “বেল রিজেক্টেড, জেসি ফর ফিফটিন ডেজ”। গোটা শরীরে এক ঝলক বিদ্যুত তরঙ্গ বয়ে যায় প্রিয়র, চার দিকে অন্ধকার হয়ে আকাশটা ভেঙে পরে মাথায়। কোন কিছু ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছেনা। মায়ের মুখটা মনে পড়ছে বার বার। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। চোখের জলের শেষ বিন্দুটাও শুকিয়ে গেছে প্রিয়শঙ্করের। মাথা নিচু করে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে গারদের ভেতর। আদালতের বাইরে তখন দম বন্ধ করা কালো প্রিজন ভ্যানটা এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক মানুষ তাঁকে দেখছে। মাটির দিকে তাকাতে তাকাতে ভ্যানে গিয়ে ওঠে প্রিয়। বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাড়িটা পৌছে যায় জেল খানার গেটে। তখনও সন্ধ্যে নামে নি। এবার মাথা নিচু করে ছোট্ট লোহার গেটটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় প্রিয়। ওর আসার খবর আগেই পৌঁছে গিয়েছিল জেলে। কলেজের সহপাঠি নকশাল নেতা রুদ্রনীল অনেকদিন থেকেই এ জেলে “মিসা” য় আটক। শান্ত প্রকৃতির মেধাবী ছাত্র রুদ্র, জেল সুপারের অত্যন্ত প্রিয়। লেখাপড়া সংক্রান্ত কাজ ছাড়াও জেলের গ্রন্থাগারের অধিকাংশ কাজ সামলাতো রুদ্র। প্রিয় যাতে একটু খাতির যত্ন পায় সে বিষয়ে আগেই সুপার সাহেবকে বলে রেখে ছিল রুদ্র। প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে রুদ্র বলে ছিল, মন খারাপ করিস না। আমি তো কবে থেকেই আছি। কোন অসুবিধা হলে আমায় বলবি।
রাতে যে ঘরটাতে প্রিয়কে নিয়ে যাওয়া হলো তার নাম আমদানি সেল। লম্বায় প্রায় সত্তোর ফুট আর পাশে পঁচিশ ফুটের মতো হবে। দু ধারে তিন ফুট বাই সাত ফুট করে ইট আর সিমেন্ট দিয়ে অসংখ্য বেদি করা। সে গুলোই শোবার খাট! খাটের পাশে পাশে সিমেণ্টের ঢাকনা ছাড়া ছোট ছোট বেড আলমারী। সেখানে টুকি টাকি রাখার যায়গা। প্রিয় তখনো কাঁদছে। কান্না দেখে প্রথম যে মানুষটি এগিয়ে এলেন তাঁকে সবাই রক্ষিতদা বলে ডাকছে। বয়স্ক, খাটো গরণের মাথার চুল সব পাকা, ছোট করে ছাটা। জালনোটের মামলায় দশ বছরের জেল হয়েছে। সে এখন আমদানি সেলের অলিখিত গর্জিয়ান। বুড়ো রক্ষিত প্রিয়র পাশে এসে বসে। বলে, মায়ের কথা মনে হচ্ছে? মন খারাপ করো না। জেলার সাহেবকে বোলো, বাড়ির লোকের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কাল তোমাকে আলাদা সেলে নিয়ে যাবে। একটা খবরের কাগজ প্রিয়কে পড়তে দিয়ে বুড়ো রক্ষিত একটানা বলে গেল ওর জীবনের নানা কাহিনী। বাড়ি ছিল গোসানীমারির কাছে ভিতর কামতা গ্রামে। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে। চাকরি জোটে নি। মহাজনের কাছ থেকে অল্প পুঁজি দাদন নিয়ে হাটে হাটে পাট তামাক কেনা বেচার কাজ করতো। বিয়ে থা করে নি। ভালই চলছিল। গিরিধারীর খবিরুদ্দিনের পাল্লায় পড়ে হঠাত্ করে বড়লোক হওয়ার সখ মাথায় চেপে বসল। খবিরুদ্দিন জাল টাকার কারবারি। ওর কাছ থেকে পঞ্চান্ন টাকা দরে জাল ইন্ডিয়ান একশটাকা কিনে হাটে হাটে ঐ টাকায় চাষীদের কাছ থেকে পাট তামাক কিনতে আরম্ভ করলো রক্ষিত। একদিন জাল টাকা সমেত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল চওড়া হাটে। খবর পেয়ে খাবিরুদ্দিন এক লাফে বাংলাদেশ। এ সব কথায় আদৌ কোন মন ছিল না প্রিয়র। লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে সে অপলক তাকিয়ে থাকে রাতের আকাশের দিকে। রাতের খাবার এসেছিল বন্ধুর বাড়ি থেকে। সে খাবার টিফিন কেরিয়ারের মধ্যেই পড়ে রইলো। দুটো কম্বল দিয়ে গেছে বুড়ো রক্ষিত। একটা পাতার আর একটা গায়ে দেওয়ার। তেলচিটে উত্কট গন্ধ। এখানে বালিশ মাশারী কিছুই দেওয়ার নিয়ম নেই, সেটাও জানিয়ে দিয়েছে।
ঘরের এক কোনায় একটা করাইতে কাঠ কয়লার আগুন জ্বালিয়ে হৈ হল্লা করছে কিছু কয়েদি। থালা বাটি বাজিয়ে উচ্চ স্বরে গান গাইছে – দেহতত্ব, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি এবং সব শেষে “উই শ্যাল ওভার কাম!” প্রিয় বসে আছে তার বিছানার এক কোনে। ঘরের ধুলো মলিন জিরো ওয়াটের আলো গুলোও নিভে যায় দশটা বাজতেই। স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে তাঁর ক্লান্ত অবসন্ন মন। ঘুমে জড়িয়ে যায় শরীর। দূর পাল্লার ট্রেন যাত্রায় গভীর রাতে যেমন ভূমিকম্পের দু:স্বপ্নে ভয়ার্ত হয়ে ওঠে প্রিয়, আজও তেমনি দেখছে হঠাত্ করে পৃথিবীর ঘূর্ণনটা থেমে গেছে! মা বাবা পরিচিতজন সবাই মিলে ভেসে চলেছে এক সাথে অচেনা অজানা কোন এক আলোক পথ ধরে অনন্ত যাত্রায়!
ভোর হয়ে গেছে। পাখিদের কলকাকলিতে ঘুম ভেঙে যায় প্রিয়র। উঁচু প্রাচীরের ধারের ছোট্ট বকুল গাছটাতে একটা কোকিল ডেকে চলেছে অনবরত। শীত প্রায় ফুরিয়ে এসেছে বসন্ত আসছে একটু একটু করে। প্রাচীরের ওপারে দমকলের আবাসনের ছাদে স্নান সেরে কাপড় মেলে দিয়ে গেলেন এক বয়স্কা মহিলা, অনেকটা তার মায়ের মত। শীত গ্রীষ্ম বারো মাস ভোরে উঠে স্নান সেরে পুজো করে সোজা রান্না ঘর। এ ছবি আবহমানকালের। আজ মনে হয় বাড়ির এ ছবিটা বদলে গেছে আমূল!
সকালে দুজন সেপাই আমদানি সেল থেকে বের করে প্রিয়কে নিয়ে যায় আন্ডার ট্রায়াল সেলে। পাশাপাশি দুটো সেল। এক একটা আট বাই দশ/এগারো হবে। সামনে এক ফালি কমন বারান্দা। বারান্দার সিঁড়ি থেকে নেমে একটু উঠোন দেয়াল দিয়ে ঘেরা, পাশেই একটা চৌবাচ্চা তার ওপর টাইম কল। পাশের সেলে কয়েক দিন আগে থেকেই আছে বিভাস সিং। বিভাসকে আগে থেকেই চিনতো প্রিয়। কলেজে ওর এক ক্লাস নিচে পড়তো। নকশাল করতো। সাহেবের হাটে এক পুলিশ কনস্টেবলকে খুনের অভিযোগে দিনহাটার টিয়াদহ থেকে ওকে ধরে এনেছে পুলিশ। প্রিয়কে দেখে খুশি হয় বিভাস। বলে মন খারাপ করিস না প্রিয়। কদিন কষ্ট কর। তোর তো দুদিন আগে পড়ে জামিন হয়ে যাবে। আমায় তো শুনছি অন্ধ্রের শ্রীকাকুলাম জেলে পাঠাচ্ছে সামনের মাসে। পিপলস ওয়ারের হাতে জোতদার খুনের মামলায়ও আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। এ জীবনে হয়তো আর ফেরা হবে না রে প্রিয়! হয়তো এনকাউন্টার করে মেরে দেবে ফলিমারির শ্যামলের মতো। ইমার্জেন্সির খাতায় আমরাও খরচ হয়ে যাবো। হাইকোর্টে মুভ করতে ক্রিমিনাল উকিল বরুণ চক্রবর্তীকে বাবা পনেরো হাজার টাকা দিয়েছিল। বরুণ কাকু কলকাতা ঘুরে এসে বলছে আরো টাকা লাগবে। পড়াশোনায় তেমন ভাল না হলেও বিভাস ভাল ম্যাজিক দেখাতো কলেজে, রবীন্দ্র সঙ্গীতও গাইত সুন্দর। আজ হতাশ বিভাসের চোখের কোণে জল দেখে প্রিয়র মনও ভেঙে যায়।
একটু পরে বুড়ো রক্ষিত এসে বলে, একটা ফালতু! তোমাকে দিয়ে গেলাম প্রিয়। ও তোমার সেলের সামনে থাকবে সারাদিন। দিনের বেলা সেল খোলাই থাকবে। তুমি এ দিক ওদিক একটু ঘুরে বেড়াতে পারো, বিকেলে লাইব্রেরীতেও যেতে পারো। কিন্তু গুনতির সময় ঠিক ঠাক চাই। সকাল থেকে ইতিমধ্যেই দু বার গুনতি হয়ে গেছে। কড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় পাঁচ দশ মিনিট। গুনতি হয়ে গেলে এক এক করে বসে পড়তে হয়। এটা গত উনিশ কুড়ি ঘণ্টায় রপ্ত করে ফেলেছে প্রিয়।
ফালতুর কোন নাম নেই, কেউ জানতেও চায় না, ওর নম্বর চৌত্রিশ। গা মালিশ, তেল মেখে দেওয়া সব কিছু করে দেবে ফালতু, বিনিময়ে শুধু চাই এক আধটা বিড়ি। আসলে বিড়ি এখানে ডলারের চেয়েও বেশি দামী! জেল খানায় তাঁকে এই সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার সবটাই রুদ্রর কেরামতি বুঝতে পারে প্রিয়। ফালতু আসলে ছোটখাটো চুরি টুরির কেসে সাজা প্রাপ্ত আসামি। তেল সাবান ব্রাশ পেস্ট ওডোমসের টিউব সব কিছুই পৌঁছে গেছে সকালে। কে দিয়েছে জানতে পারে নি প্রিয়। প্যকেট খোলার সময় বিড়ির আশায় লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফালতু। বিড়ি না থাকায়, মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেল ওর!
সকালে যে বস্তুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট হয়েছে জেলখানায় তার নাম “মারি”। চালের খুদ আর তরকারির ফেলে দেওয়া ডাটাপাতা এক সাথে সেদ্ধ করে সুপের মত একটা সেমিসলিড খাদ্য বা পানীয়। কেউ আবার বলছে “লাফসি”। প্রিয়র মুখে রোচে নি একদম। অনেকে আবার দু তিন বার করেও খাচ্ছে! দুপুর হলো। মন্দিরে চরণামৃত দেওয়ার তামার চামচের থেকেও ছোট একটা চামচে করে দু চামচ সর্ষের তেল দিয়ে গেল গায়ে মাখার জন্য আর একজন ফালতু। উঠোনের চৌবাচ্চার জলে স্নান সেরে নেয় প্রিয়। টিফিন কেরিয়ার ভর্তি করে প্রচুর খাবার এসেছে বন্ধু স্বপনদের বাড়ি থেকে। এবার প্রিয় বিভাসকে ডেকে নেয়, বলে “চল একসাথে খেয়ে নি”। প্রথমটা একটু আমতা আমতা করলেও বারান্দায় এক সাথেই খেতে বসে যায় দুজনে। থালা বাটি মেজে দিয়ে ফালতু বলে, “দাদার ঘর, তোমার মান্সিটাক মোর বিড়িটা ধরি আইসার কন। বিড়ি না পাইলেক মোর দমকনা বন্দ হইয়া আইসে”। সেলের সিঁড়িতে বসে ফালতু সবে বলতে শুরু করে, “মোর নাম সুরত বর্মন, বাড়ি হাড়িভাঙা”। এরপর ওদের একশ বিঘা জমির গল্প পারতেই, ধমক দিয়ে ওঠে বিভাস। বলে, ওসব কথা রাখ। আগে একটা ছিলিম বানা । হতাশায় জেলে এসে গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়েছে বিভাস। ছোট্ট একটা কাগজের পুড়িয়া পকেট থেকে বের করে দেয় বিভাস। ফালতু সুন্দর করে ছিলিম সাজিয়ে দেয়। টানতে টানতে বিভাস বলে, নে এবার দাদাকে জেলের কথা শোনা। বিভাস জানতো, ফালতু এই জেলের লিভিং এনসাইক্লোপেডিয়া। ফালতু বলে চলে, “ভাইও, এটে নষ্কালরা এক নম্বরত, উয়ার পাছত, এক এক করি ডাকাইত, চোর, আর পকেট সোন্দার ঘর। নারী ধস্সনকারি সকার নিচত। মাইওর গাওত যায় হাত নাগায় উয়ায় আবার মান্সি ? উয়ার নাগান পাইলে গেলে ভাল করি বাঁশডলা দ্যাওয়া খায়। শালার ব্যাটা শালা। ওটে দ্যাকো, শহীদভাই যাবার ধইচ্চে। ঊঁয়ায় আগত আঠারোকোঠা কালপাণি দাপে ব্যাড়াসে। দশ বছর আগত চিল্কিরহাটত ডাকাতি করির যায়য়া উয়ার দুই চ্যালা আজ্জি পার্টির হাতত ধরা পইল্লেক। ঘাটার মান্সিগুলা উমরাক হাই-নরমাল (উত্তম-মাধ্যম) দিলেক। মারেয়ার বিচারত নুরুন দিয়া উমরার চোখ তুলি চুন ঢালি দেলো সকায়। এলা বৌ বেটির হাত ধরি বামনহাট-শিলিগুড়ি লাইনত গান করি ভিক্ক্যা করি ব্যারায়। শহীদ স্যেলা গ্রাম ছাড়ি পালে যায়য়া রেলত ডাকাতি করি ব্যারাছে। শ্যাসে, ডালখোলাত পুলিশ উমরাক ধরি ফ্যালে। সেই থাকি এটে আটক”। কথা শেষ করে ডাক দেয় ফালতু, “শহীদদা, এটে আইসো”। ধীর পায়ে শহীদ এসে বসে ওদের সামনে। প্রিয়র দিকে তাকিয়ে শহীদ বলে, “দাদা, তোমরার তো ঘর পোড়া কেস ? বোমও ফাটেসিলেন শুইনলং। চিন্তা করেন না, কায় দেয় সাক্ষী! কিসুই হবার নয়, চুপ করি বসি থাকো। মুই কইলং কোতয়ালির মেজবাবু খান সেহেবক পাইলেক না ছারং । শালার ঘর মোক ঝুলি দিয়া এমন ডাং ডাঙ্গাইছে, কি কং ভাইও, এলা মোর বাম পাওটা কমজোরি হয়া গেইচে। আক্রাহাটর রাজমোহন বৈদ্যর চিকিত্সাত এলা একটু ঘুড়িফিরি ব্যারার পাই। তিন কাল মোর চলি গেইচে, এলা সাধুসঙ্গ করা খাইবে। তোমরা বিশ্বাস করেন, মুই জীবনত মানুষ খুন করং নাই”। হঠাত্ ওয়াচ টাওয়ার থেকে বাঁশি বেজে ওঠে। শহীদ বলে, “এলা মুই যাঙ্গ দাদার ঘর, পাছত কথা হইবে”।
বিকেল হয়ে এসেছে। এক সিপাই এসে খবর দেয়, প্রিয়শংকর বাবু আপনাকে জেলার সাহেব ডাকছেন। চলুন আমার সাথে। প্রিয় গিয়ে দেখে জেলার সাহেবের অফিস ঘরে ওর দুই দিদি ওর জন্য অপেক্ষা করছে। প্রিয় সামনে যেতেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে দিদিরা। রুদ্র শান্ত করে ওদের। বলে, কোন চিন্তা করবেন না দিদি, এখানে কোন কষ্ট হবে না। আমি দেখে রাখবো। মিষ্টি কেক বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে এসেছে ওরা ভাইয়ের জন্য। প্রিয় শুধু বলে মাকে বলিস, আমি ভাল আছি। চোখের জল মুছতে মুছতে ভেতরে চলে যায়।
পরদিন সকালে ফালতু এসে খবর দিল, “দাদার ঘর, আজি তোমাক গাও মাখার ত্যাল না দ্যায়। জেলার সাহেব কালি চলি যাইবে। আজি উয়ার বিদায় সভা। গান বাজনা হইবে আর খাওয়া দাওয়া। ওই ত্যাল দিয়া লুচি বানাবার ধইচ্চে”। ফালতুর স্কুপ নিউজে বিস্মিত হয়ে যায় প্রিয়! আগের দিন রক্ষিতের কাছ থেকে কাগজ পেন নিয়ে খালি টিফিন কেরিয়ারের ভেতর চিরকুট পাঠিয়েছিল প্রিয়। আজ সাত প্যাকেট বিড়ি পৌছে গেছে খাবারের সাথে। ফালতুকে ডেকে এক প্যাকেট তুলে দেয় ওর হাতে। মুহূর্তের মধ্যে ওর মধ্যে এক নিবিড় প্রশান্তি লক্ষ্য করে প্রিয়। একটা গোটা দ্বীপের মালিকানা হাতে পেলেও বোধ হয় মানুষ এতটা খুশি হতো না! দু হাত তুলে বার বার প্রণাম করে। বকুল গাছটার ছায়ায় বসে মনের সুখে বিড়ি টানতে থাকে ফালতু। বিভাস বলে, এটা ঠিক করলি না প্রিয়, এতো গুলো বিড়ি কেউ একসাথে দেয়!
জেলখানায় এক একটা দিন এক একটা বছর মনে হয় প্রিয়র। সময় কিছুতেই কাটতে চায় না। এরই মধ্যে একদিন জ্বর এলো ভীষণ। গা পুড়ে যাচ্ছে। ফালতু মাথায় জল ঢেলে দিল অনেকক্ষণ। জ্বর কমলো না। রক্ষিতকে বলে ফালতু জেলের ভেতরে হাসপাতালে নিয়ে গেল প্রিয়কে। ডাক্তার পাল দিনে একবার আসেন ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। বাকি সময় বাড়িতে বসে প্র্যাকটিস করেন। ওনাকে প্রিয় বললো, ডাক্তার বাবু, কাল থেকে আমার ভীষণ জ্বর গায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা। ডাক্তার বাবু, প্রেস্ক্রিপশন না করে ওষুধ না দিয়ে উল্টো বললেন, “ও তাই নাকি আমারও তো কাল থেকে জ্বর, গায়ে ভীষণ ব্যাথা! এখন সিজন চেঞ্জ হচ্ছে তো তাই। কালই দেখবে সব সেরে যাবে”। ফিরে আসার পর বিভাস বললো, সবাইকেই ও ব্যাটা একই কথা বলে। ফালতু গিয়ে রুদ্রকে খবর দেয়। রুদ্র ছুটে আসে। সুপার সাহেবকে বলে বাইরে থেকে ওষুধ আনিয়ে দেয়।
শহরে কংগ্রেসের দুই গোষ্ঠীর মারামারি চলছে। সন্ধ্যে লাগতেই রাস্তা ঘাট শুনশান হয়ে যায়। নতুন পাঞ্জাবি এস পি এসেছেন। ভীষণ কড়া। ধরপাকর চলছে। জেলের ভেতর থেকে এ সব কিছু বোঝার উপায় নেই। সেন্ট্রিরা এসে রাতের খাবার ও খবর দুই দিয়ে যায়। এ জন্য ওদের সাথে আলাদা বন্দোবস্ত করা থাকে।
এ ভাবেই কাটতে থাকে দিনের পর দিন। পনের দিন পর পর জেল থেকে কোর্ট, আবার কোর্ট থেকে জেলখানা। পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও প্রিয়র বিরুদ্ধে তেমন কোন তথ্য প্রমাণ যোগাড় করতে পারে না, শুধু কিছু পোড়া খড়কুটো আর ছাই ছাড়া। গভীর রাতে নিরঞ্জন দেওয়ানীর বাড়ি পুড়ে যাওয়ার ঘটনার কোন সাক্ষীও খুঁজে পাওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত। এদিকে গোটা শহরের জনমত একটু একটু করে প্রিয়র দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেছে। প্রিয়র নি:শর্ত মুক্তির দাবিতে আদালতের সামনে বিক্ষোভে ঢল নামে মামলার তারিখে। শেষ পর্যন্ত জামিন হয়ে গেল, সপ্তাহে একদিন করে থানা হাজিরার শর্তে। ব্রজেন মহুরী আর আনোয়ার উকিল হাত ভরে টাকা গুণে নিলো। জি॰আর কোর্ট থেকে জেলখানায় কাগজ পৌঁছাতে আরো পাঁচশো টাকা। প্রিয় পৌছানোর আগেই কাগজ উড়ে পৌছে গেল জেলখানায়। সেন্ট্রিদের বক্সিস মিটিয়ে সন্ধ্যায় ছাড়া পায় প্রিয়। এর পর থেকে প্রতি সোমবার একটা চার নম্বরী খাতা নিয়ে থানার ডিউটি অফিসারের কাছে হাজির হতো প্রিয়শঙ্কর। অফিসার তাতে সিল মেরে লিখে দিতেন “অ্যাটেন্ডেড কোতওয়ালি পি এস”। দিনের পর পর দিন ধরে মামলার তারিখ আর থানা হাজিরায় বিপর্যস্ত প্রিয়শঙ্করের বেকার জীবন আরো দীর্ঘায়িত হয়ে যায়। প্রতি তারিখেই মায়ের কাছে মাথা নিচু করে হাত পেতে টাকা নিয়ে উকিলবাবুদের পকেট ভরাতে হয়েছে বেকার প্রিয়র। শেষ পর্যন্ত তদন্তকারি অফিসার ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করেন আদালতে। বছর তিনেক চরকি ঘোরার পর একদিন মুক্তি পায় প্রিয়। স্নান সেরে পুজো দিয়ে সকাল সকাল আজ আদালতে হাজির হয়েছে প্রিয়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে আলতো করে কামড়ে দেয় মা। ঠিক বারোটায় হাকিম এসে বসেন এজলাসে। পরিচিত পেশকার অনিমেষ দা প্রিয়র দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হেসেই আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। এবার গুরুগম্ভীর স্বরে হাকিম বলে চলেন, “প্রিয়শঙ্কর ব্যানার্জী, সন অফ – শ্রী সুবোধকুমার ব্যানার্জী অফ কোচবিহার অনারেবলি একুইটেড অফ অল দি চার্জেস প্রেফার্ড এগেনস্ট হিম ইন দি কেস ….. ”
এবার ধীর পায়ে আদালত থেকে বেরিয়ে গিয়ে সাগরদিঘীর ঘাটে একলা বসে মরুশুমি পাখিদের কল কাকলিতে বিভোর হয়ে ওঠে নির্দোষ নিষ্পাপ মুক্ত প্রিয়শঙ্কর। ডানা ঝাপ্টে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে ভিন দেশী নাম না জানা পাখির দল। উদাস প্রিয় ভাবে, দুদিন পর ওরাও তো উড়ে যাবে কোন অচিন দেশে। এই মুক্ত বিহঙ্গদের মত তারও উড়ে যেতে ইচ্ছা করছে অন্য খানে, অন্য কোন দেশে যেখানে প্রিয়শঙ্কর বলে কেউ তাঁকে চিনবে না, ও নাম ধরে ডাকবে না কেউ কোনদিন!
——
Emergency cholche nirontor,