মার্চ১০, ২০১৯, কুলিক রোববার :
সখী এমন বাদলে…
মৈত্রেয়ী সান্যাল
সকাল থেকেই ঝমঝম করে বৃষ্টি।কাজের মাসি নিঃসন্দেহে আজ ডুব দেবেই ! কাজেই অপেক্ষা না করে ছেলেকে স্কুলের বাস ধরানো, রান্নার জোগাড়, টুকটাক কাচাকুচি …. শুরু করে দেয় অনুরাধা। সব শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে যথারীতি সেও অপেক্ষা করেনি কারোর জন্য !! অতঃপর কোনোরকমে তৈরি হয়ে টিফিন হিসেবে রান্না করা ভাত মাঝের ঝোল নিয়েই দুদ্দার ছুটলো অনু। দেরিতে অফিস পৌঁছে পুরুষ সহকর্মীদের টীকা টিপ্পনি কি অযাচিত সহমর্মিতা একেবারেই সহ্য করতে পারে না সে। বিশেষ করে যবে থেকে সে ছেলেকে নিয়ে একা (!!) থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন থেকেই তো পুরুষ – মহিলা নির্বিশেষে সকলের এক চরম কৌতূহলের বিষয় হয়ে উঠেছে অনু ওরফে অনুরাধা সেন ।
ছাতা মাথায় শাড়ি- ব্যাগ সামলে চলতে গিয়ে বেশ খানিকটা ভিজতেই হলো তাকে। অফিসে পৌঁছে মুখ মাথা মুছে পাখার তলায় ভেজা চুল শাড়ি শুকাতে শুকাতে এক কাপ চা নিলো ক্যান্টিন থেকে। জানলা খুলে বাইরে তাকিয়েই ঘন সবুজ ঘাসে ভরা বি এড কলেজের মাঠের মাঝখানে একলা দাঁড়িয়ে থাকা ছাতিম গাছটাকে দেখে কেমন যেন নিজের সাথে মিল খুঁজে পেল । এত্তবড়ো পৃথিবীতে একেবারেই একলা সে ….. মাথার ওপর সমস্যার অঝোর বর্ষণ !! গাছটার মতোই প্রকৃতির রোষে যেকোনো সময় দগ্ধ হয়ে যাবার প্রবল সম্ভবনা নিয়েও মাথা তুলে নিজের অস্তিত্ব জানান দেবার কি প্রতিস্পর্ধী চেষ্টা !!
কখন যেন অজান্তেই গুনগুন করে গাইতে থাকে “ সখী এমন বাদলে তুমি কোথা ….” । ভিজে ওঠা চোখে ভেসে আসে সাত বছর আগের এমনই এক বৃষ্টির দিন। সেদিন ও এরকম ই এক ছাতিম তলায় বৃষ্টি কে সাক্ষী রেখে সৈকত গেয়েছিলো এই একই গান !! শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস প্রকৃতিও সেদিন অসীম মুগ্ধতায় দেখেছিলো দুটো আবেগী তরুণ প্রানের আত্মনিবেদন । কেমিস্ট্রি র সৈকত বসু আর সমাজ বিজ্ঞানের অনুরাধা সেন …. তখন রীতিমতো চর্চার বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তারপর তো কত হিসেব – কত হাসি – কত কান্না !! বিয়ে করা ,একসাথে সংসার, ছেলে ‘সঞ্চয়’ এর জন্ম …..
তাল কিন্তু কাটছিলো বারে বারেই । পাঁচ বছরের সংসার জীবনে বৃষ্টি, রবীন্দ্রনাথ আর পাহাড়ে বেড়াতে যাবার মিল ছাড়া রোজ ই দাঁত- নখ বের করে আছড়িয়ে পরছিল অসংখ্য অমিল !! টুকটাক মতবিরোধ, মনোমালিন্য , অভিমান ক্রমশ ভয়ঙ্কর রূপ নিতে শুরু করলো যখন তখনি সিদ্ধান্ত নেয় অনু। দু বছরের ‘সঞ্চয়’ কে নিয়ে আর নিজের সামান্য একটা চুক্তিভিত্তিক চাকরি র ওপরে দাঁড়িয়ে সৈকতের নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে আসে সে। নিজের আত্মীয় – পরিজন ,বন্ধু – বান্ধব মায় বাবা – মাও সেসময় অনেক বুঝিয়েছিলো ওকে। বলেছিলো মানিয়ে নিতে, ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে , নিজের সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে …..
অনেক ভেবেছিলো অনু ….
কিন্তু রোজ রোজের অশান্তি – পরস্পর কে অপমান – সন্দেহ করতে করতে নিজেদের ভালোত্ত্ব টুকুকে শেষ হয়ে যেতে দেখতে পারছিলো না অনু।
ওর নিজের ও দরকার ছিলো একটু সরে থাকার …
সৈকতের ও …….
নিজেদের চিনতে, বুঝতে এই আড়াল টুকুর বড্ডো দরকার হয়ে পরেছিল যে ……
নিজের ভাবনায় , চোখের জলে এতটাই বিভোর ছিলো অনু যে চমকেই উঠলো ব্যাগের ভেতরের চেনে রাখা মোবাইলের শব্দে। বের করতে করতেই কেটে গেলো ফোনটা।
মিস কল এলার্টে গিয়ে চমকে উঠলো অনু …..
স্ক্রিন বলছে ফোনটা এসেছিলো যার কাছ থেকে তার নামটা এখনো সেভ হয়ে আছে “আমার তুমি “ হয়ে …..
তবে কি মেঘেরা আজো বার্তাবহ …?????