
স্নিগ্ধা সরকার
শোনো নরহরি তোমার ভাগ্য ভালো তাই এমন সম্বন্ধ দিচ্ছি। পাত্র মুখার্জি বংশের ছেলে। যেমন রূপে সুন্দর তেমনি সুন্দর গুনে। অনেক নম্বর নিয়ে আই.এ. পাস দিয়েছে।
দরজার আড়াল থেকে নরহরির বউ সুরমা দাওয়ার দিকে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘পাত্রের গণ আর রাশিটা শুনে নাও।’
—-বৌমাকে পাত্র দেবগণ , মীনরাশি। তোমার খুকির সাথে সবদিক দিয়ে খুব ভালো যাবে, তাইতো এই সম্বন্ধে এনেছি। আমার উপরে ভরসা করে মেয়ের বিয়ে দাও। মেয়ে খুব সুখী হবে। বনেদী ঘর হলেও তোমার মেয়ের কথা শুনে ওরা ভীষণ আগ্রহী। তোমার মেয়েকে দেখতে চেয়েছে। যদি তোমরা সম্মতি দাও তাহলে সামনের মাসেই ওরা আসবে মেয়েকে দেখতে।
তিন মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল নরহরির মেয়ে প্রতিমা আর মাধবগ্রামের মুখুজ্জোদের ছেলে মহেন্দ্রর। তবে মেয়ের সর্বাঙ্গ সোনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এই দাবি ছিল মহেন্দ্র ঠাকুরমা যোগোমায়াদেবীর। নরহরির আপত্তি থাকলেও সুরমা আর পরিমল ঘটকের জোড়াজোড়িতে শেষ অবধি নরহরি রাজি হয়ে গেল।
নরহরিও একটি শর্ত দিল, ‘ একমাত্র মেয়েকে যতটুকু সাজিয়ে দেওয়ার অবশ্যই দেব। বাদ বাকি গয়না ও দানের বাসন সমস্ত আমি সিন্দুকে ভরে দেব যাতে নদীপথে কোন বিপদ না আসে।’
মেয়ের বিদায়কালে এক নৌকায় মেয়ে জামাই আর বরযাত্রীরা আরেক নৌকায় গেল অপূর্ব কারুকার্য করা কাঠের সিন্দুক আর কিছু লেঠেল। নৌকায় আরো একজন ছিল যার কথা কেউ জানত না। মেয়ে জামাইকে আশীর্বাদ করে ধুতির খুটে চোখ মুছতে মুছতে সবার আড়ালে নরহরি বাড়ির বাইরের বটগাছের নিচে গিয়ে ডাক দিল, ‘পাঁচু যা খুকির সাথে খুকিকে দেখে রাখিস। আমার যেন ওবাড়িতে মুখ থাকে।’
সিন্দুকের নৌকাটা পারে কাছাকাছি আসাতেই আওয়াজ পাওয়া যায়, ‘হারে রে রে রে রে’। ঠিক সেই সময়ই প্রচন্ড হওয়া ওঠে। ডাকাতের আওয়াজ আর পাওয়া যায়নি। সিন্দুক নির্বিঘ্নে পৌঁছে যায় মুখার্জি বাড়িতে।
নতুন বউ বাড়িতে ঢোকার পর আশীর্বাদ, নিয়মকানুন সবকিছু নির্বিঘ্নে মিটে গেলে যোগমায়াদেবী বড়ছেলেকে ডেকে বলে সিন্দুকের ডালাখানা খুলতে। সিন্দুকের চাবি নরহরি মহেন্দ্রর ছোটকাকা বলেন্দ্রর কাছে দিয়েছিল। তাই এবারে বলেন্দ্রর ডাক পড়ল। কিন্তু বলেন্দ্র চাবিটা খুঁজে পেলনা এবং মনেও করতে পারলনা কোথায় রেখেছে। তারপর যোগমায়া দেবীর বড়ছেলে নরেন্দ্র বলল, ‘বৌভাত যাক। বাড়ি একটু ফাঁকা হোক তারপর তুমি সিন্দুক খুলে সবকিছু দেখে নিও।’
বৌভাত পেরোলো ,বাড়িও ফাঁকা হলো। সিন্দুকের চাবি যোগমায়াদেবীর হাতে চলে এসেছে। কিন্তু যখনই সিন্দুক খোলার কথা হয় তখনই হয় চাবি পাওয়া যায়না, নয়তো কোনো না কোনো বিপদ এসে উপস্থিত হয় সেইমুহূর্তে। এইভাবেই বেশ কয়েক মাস কেটে গেল যোগমায়াদেবীর আর সিন্দুক খুলে দেখা হলনা।
মহেন্দ্র আর প্রতিমার বিয়ের প্রায় ছয় মাস বাদে হঠাৎ একদিন ডাকাত পড়লো মুখার্জি বাড়িতে। সেই কি ভয়ানক পরিস্থিতি। বেশ রাতের ঘটনা। সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ করে বাড়ির উঠোনে কোলাহল শোনা গেল। দারোয়ান তখন তীব্র যন্ত্রণায় মাটিতে কাতরাচ্ছে । লাথি মেরে মেরে সব ঘরের দরজা ভেঙে যে ঘর থেকে যা পেয়েছে সবই লুটে নিয়েছে। যোগমায়া দেবীর শখের সীতাহারটা এক টানে গলা থেকে ছিঁড়ে নিয়েছে ডাকাত সর্দার।
ভালো ঘটনাটা হল দোতালার উত্তর দিকের ঘরটাতে যখন একজন ডাকাত দৌড়ে গিয়ে লাথি মেরে দরজা ভাঙতে নিল তখন সে শুকনো খটখটে বারান্দায় পিছলে পরে। আর শুধু পরেই নি হয়তো বাঁপাটাও ভেঙেছে। শেষে বাকি ডাকাতেরা তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে পালায়। ফলে মহেন্দ্র আর প্রতিমার ঘর থেকে ডাকাতেরা কিছুই নিতে পারেনি। যে সিন্দুক লুট করার আশায় সেদিনের সেই ডাকাতি সেটা আর পূরণ হলনা। আর আশ্চর্য ঘটনা হলো এত কাণ্ড যে বাড়িতে ঘটে গেল এর কোনো কিছুই প্রতিমা বা মহেন্দ্র টের পায়নি । তারা সকালবেলায় উঠে সবকিছু শুনে অবাক।
বড়বউ আর ছোটবউয়ের গায়ে বেশ ভালই গয়না থাকত সবসময় সবটাই লুটেছে ডাকাতেরা। ছেলেদের গলায় বেশ মোটা মোটা চেন ছিল, হাতে বেশ ক’টা করে সোনার আংটি ছিল সবই নিয়েছে ডাকাতেরা। যোগমায়াদেবী তেমন কিছু গয়না পড়তেন না গলার সীতাহার আর হাতে একজোড়া বালা সেটুকুও নিয়েছে। পরদিন হিসেব করে দেখা গেল বেশ ভাল রকমের সোনা এবং টাকা-পয়সা লুট করেছে ডাকাতেরা। তবে একটা ভালো যে মহেন্দ্রর ঘরে ঢোকেনি ডাকাতেরা।
কিন্তু যোগমায়াদেবী সীতা হারের সব কিছুতেই ভুলতে পারছে না। বেশ অনেকবার তার বলা হয়ে গেল, ‘আমার ঠাকুমার শেষ স্মৃতি ছিল এই সীতাহারটা। বিয়ের দিন থেকে একভাবে পড়ে আছি। কোনদিন গলা থেকে খুলিনি। সেটা যে এইভাবে চলে যাবে আমি কখনো ভাবিনি।’
চার -পাঁচ দিন বাদে ডাকাতির খবর পেয়ে নরহরি এলো মেয়ের বাড়িতে। সব খোঁজ-খবর নিল কুশল বিনিময় হল। এবং ভগবানের কাছে প্রার্থনা করল তাদের কুশলের। বেয়াই বাড়ির আপ্যায়ন সাথে মেয়ের সুখ দেখে সে ভীষন খুশি হলো। মধ্যাহ্নভোজনের পর বিশ্রাম করে নিয়ে কিছুক্ষন মেয়ের সাথে একলা বসে গল্প করল। আজ নরহরি তার খুকিকে এমন কিছু কথা জানাল যেগুলো খুকি এতদিন জানতো না।
—-মা গো তোমাকে আমি খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিয়ে দিয়েছি সেটা তুমি জানো। এবং এও জানো আমার আর্থিক অবস্থা কেমন। পরিমল ঘটক এবং তোমার মায়ের ইচ্ছাতেই এই বিয়েতে আমি সম্মত হই। ভাগ্যিস আমি সেদিন সম্মত হয়েছিলাম। তাই আজ তোমাকে এত সুখি দেখে আমিও খুশি হচ্ছি। তুমি তো জানো তোমার ঠাকুমা শাশুড়ি আমার কাছে দাবি করেছিলেন তোমার গা ভর্তি গয়না দেওয়ার জন্য। বিয়ের আসরে তোমাকে সামান্য গয়নায় সাজিয়ে দিয়েছিলাম। তারপরে বলেছিলাম বাদবাকি গয়না বাসন সমস্ত সবকিছু এই সিন্দুকে আমি ভরে পাঠিয়েছি। আমি সবটাই মিথ্যে বলেছিলাম। এই সিন্দুক আমি ফাঁকা পাঠিয়েছি। আজও এই সিন্দুক ফাঁকা।
—-কি বলছো বাবা! যদিও এখনও কেউ এই সিন্দুক খুলে দেখেনি। দেখলে তোমার মান-সম্মান একদম মাটিতে মিশে যেত।
—–কেউ এই সিন্দুক খুলতে পারবে না। যতদিন না এই সিন্দুক ভর্তি করে দিতে পারছি। আমি চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি পারবো এই সিন্দুক ভরে দেব। ভরে দেওয়ার পর সবাই দেখতে পাবে সিন্দুক ভর্তি আছে।
—– কিন্তু কিভাবে?
—- তোমাকে একটা গোপন কথা বলছি। তুমি সেই কথা কাউকে বলো না যতদিন না আমি অনুমতি দেবো। সেই কথা তোমার মাও জানে না। তোমাকে ছোটবেলায় বলতাম মনে আছে? বট গাছের পাঁচু থাকে। তুমি দুষ্টুমি করলে পাঁচু তোমাকে ধরে নিয়ে বটগাছে বসিয়ে রাখবে। সেই পাঁচু কিন্তু মিথ্যে ছিল না। বটগাছে সত্যিই পাঁচু থাকতো। সেই পাঁচুকে আমি তোমার সাথে পাঠিয়েছি আমার সম্মান রক্ষা করার জন্য।
—–আমি তো কখনো বুঝতে পারিনি।
—– পাঁচু বুঝতে দেয়নি তাই। দাঁড়াও তোমাকে দেখাই। পাঁচু এই পাঁচু আয়তো এখানে।
অমনি একটা জানালার পর্দা হাওয়ায় উড়ল।
—- এইযে পাঁচু এল।
টেবিলে রাখা কাঁসার গ্লাসটার ঢাকনা খুলে গেল। সাথে সাথে কাঁসার গ্লাসটা হাওয়ায় উঠে গেল । আর আস্তে আস্তে গ্লাসের জল উধাও হয়ে গেল। প্রতিমার চোখদুটো একেবারে বড় বড় হয়ে গেল।
নরহরি বলল, ‘ভয় পাস না। ও কোন ক্ষতি করবে না। ও আমার অনেক উপকার করেছে। আট বছর খানেক সময় দে আমাকে তারপর এই আমি তোর সিন্দুক ভরে দেবো।’
—-কিন্তু কিভাবে?
—– ভরসা রাখ আমার ওপরে। ওরকম হুট করে তোর বিয়েটা নাহলে হয়তো তখনই সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে পারতাম। আমি পাঁচুকে দিয়েই সব পাঠিয়ে তোর সিন্দুক ভরে দেবো। তারপরেই সবাই এই সিন্দুক খুলতে পারবে আর কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু ততদিন পাঁচু এই সিন্দুকে আগলে রাখবে । যতই চেষ্টা করুক সবাই কিছুতেই এই সিন্দুক খুলতে পারবে না কেউ। আসলে পাঁচু খুলতে দেবেনা। আজ আসি বুঝলি তোর মা ঐদিকে চিন্তা করছে তোর মাকে গিয়ে খবরটা দেই তোরা সবাই ভালো আছিস।
—–আজকের দিনটা থেকে যাও বাবা।
—–আসবো মা যেদিন যৌতুকের সবটা দিতে পারব সেদিন বুক ফুলিয়ে এসে থেকে যাব। যতদিন না দিতে পারছি ততদিন তো নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে আছি। আর কিছু দরকার হলে বলবি পাঁচুকে ও আমাদের খবর এনে দেবে। তুই একদম আমাদের জন্য চিন্তা করবি না ভালো থাক।
কথাটুকু বলে বিছানা থেকে শালটা তুলে নিয়ে কাঁধের ওপর ফেলল। তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নরহরি রওনা দিল। ফিরে এলো নিজের বাড়িতে।