আফতাব হোসেন
যাচ্ছেতাই …
আরবে কেউ নাই আমার । ঘরের লোক বেছে বেছে ইয়া বড় মুসলমান নাম কিকরে রাখলো তা আজ অবধি বুঝিনি । নামের আগে আবার শেখ আছে আমার । আধার , রেশন, ভোটার সব ভুলের বাধা টপকে যখন সরকারি খাতায় ঠিক নাম দেখি তখন একটু জিরান আসে মনে । তাও শান্তি নাই । ইদিকের পঞ্চায়েত মেম্বার হেব্বি খাতির করে বলে কিনা আপনে মুরুব্বি মানুষ ।
জীবনে কিচ্ছু গোছাতে পারিনি । তাই কয়েক বছর ধরে নিজের ইমেজ গোছাচ্ছি । পলিটিক্যাল ইমেজ । নন পলিটিক্যাল নাকি আ পলিটিক্যাল জানি না । তবে দুটোই গোছাচ্ছি । সময় থাকতে শিখেছি সব কিছু আধা উত্তরে পুরা সম্মান পাওয়া যায় । সারাজীবন মুকুল থাকা ভালো । ফুল ফল হয়ে পাকলেই সালা মাটিতে পড়বো না হয় কারো পেটে যাবো এটুকু শিওর ।
বেশ কদিন আগে গ্রামের মুরুব্বি সদ্য বিদেশী ধর্মডিগ্রী ধোঁয়ার ফাঁকে সুধিয়েছিল হাল কি বোঝেন মাস্টার ? জ্যোতি বসুর আমল হলে বলতাম লবার হাল । এখন উপায় নাই । একে মাস্টার তায় মুরুব্বি । জিলেট সেভিং দাঁড়ি চুলকে বললাম চাপ আছে , তবে চাপেই তো বাপ হয় বলুন । দেখুন না কি হয় ।
আল্লাতালা আমাদের সঙ্গেই ..
উনি তখন কি বুঝেছিলেন জানি না ।
তবে কদিন আগে দেখাতে একেবারে বুকে জড়িয়ে এককাকার …
বললেন,
আপনে ঠিকই বলেছিলেন ..
আলহামদুলিল্লা , বাপ বাপ ই থাকে..
দেখেছেন না সালাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছি ।
আপনাগো দ্যাসেও তো সালা মীরজাফর কে এমন মুর্শিদ খাঁ দেখিয়েছি না ও সালা মনে রাখবে মরা পর্যন্ত্য ।
বললাম,
চাচা আমি বায়োলজির , ইতিহাস বুঝিই না , এটা তো আবার পলিটিক্যাল সায়েন্স ।
কি বুঝলো কে জানে ।
বললো ইবার মেম্বার হয়েছি । জালসা র মেহ্ফিল দিয়েছি জুম্মাবার । আসতেই হবে । রাজস্থানের ইস্কলার । এখন উত্তরপদেশে খুব চল ওনার । ছুয়ারা বলে ইটুব বলে একটা টিভিতে উহার বিরাট ফ্যান । খুদার রূপ পুরা চোখে, এমন তেজ … নয় হাজারে বুক করেছি , আসতেই হবে ।
পঞ্চায়েত মেম্বারের রিকোয়েস্ট । উপায় নাই ।
তাই
জুম্মাবারে একবারে সামনের সারিতে .. খুদার কাছাকাছি ।
সব শুনলাম…
শফি মোল্লা থেকে শেক্সপিয়র , কামারুজ্জামান থেকে করোনা , মীরজাফর থেকে এনার্সি , ভ্যাকসিন থেকে ফ্লাইওভার ,ঈমান থেকে লক্ষি ভান্ডার ।
সওওব..
বললো আল্লার গজব নেমেছে আমেরিকার ওপর । সালাদের আফগানিস্থান থেকে খেদিয়েছি । বলুন সুবানাল্লাহ…
বললাম ,
ভাবছিলাম ফিদা হয়ে । সব্বাই বুঝছে হিন্দি । ভুলে গিয়েছিলাম ওইদিন আবার হিন্দির নাকি দিন ছিল ।
তাল কাটলো এগারো বছরের পুঁচকের চিৎকারে।
আমারই ছাত্র । জানি,
অংকে নব্বই আর বিজ্ঞানে ছিআশি ছিল গেলবার,
– “মোক যাতে দিতে হবেক , মুই জাবুই…”
জাপটে ধরে আপ্রাণ ওর আব্বা ।
ছেলে চিল চিৎকার
– ” জাবক জাবক জাবক “…
সাথে নাকে ঝরঝর করে সর্দি ..
ওর আব্বার অবস্থা তথৈবচ ।
আবার চিৎকার ।
আমায় সামনে দেখে সুর একটু বাড়লো মনে হয় ।
– ” ও স্যার মোক যাতে দে “..
ইশারার প্রশ্রয় এ এলো । আমার দিকে না তাকিয়ে সোজা
হুজুরের পায়ে মাথা রেখে সে কি কান্না ।
হুজুর সর্দি বাঁচিয়ে আরবি ভাষায় নিজেকে লুকলো
আর আমার অংকে নব্বই এর গর্বে সামনের বেঞ্চে বসে থাকা আমি হতাশায় মুখ লুকোলাম মোবাইলে ।
তারপর একঘন্টা সবে । সিরাম ইন্টারন্যাশনাল এর কোভিশিল্ড এর ফর্মুলা হুজুরের গলায় , দেশি ভ্যাকসিনে নাকি মোদির তৈরি , না নেওয়াই ভালো । শুনলাম । ভ্যাকসিনের হালাল হারাম আছে । শুনলাম । ভ্যাকসিন না নিয়েই তালিবান বেঁচে আছে । সেটাও শুনলাম । এদিকে হোয়াটস আপ এ সব চেক করা কমপ্লিট আমার । মেসেঞ্জার সব ক্লিয়ার । জলসাও শেষ । আমার কনফিডেন্স ও । সালাম না সেরে আসায় মাইকে শুনলাম বাজছে গভীর কন্ঠ-
” আল্লাতালা সব দেখে রহা হে …”
বাইকের পেছনে খালি দেখে সওয়ারী নিল একজন । ওই পুঁচকার বাপ । বললো মাস্টার চিনি তোকে , ছুয়াটা একা গেছে । অনেকটা । একটু আগায় দে ।
পুরো ঘর পর্যন্ত্য এগোলাম।
নামাবার সময় কি খেয়ালে পুঁচকে কে ডাকাডাকি তে না আসায় ভেতরে গেলাম । অনিচ্ছায় ।
দেখলাম
এগারো বছরের নাকে সর্দি, গ্লাস নিয়ে বসে চামচে করে জল খাওয়াচ্ছে কাউকে । শুয়ে আছে কেউ । অসুস্থ ।
মাস্ক ওপরে তুলে হাত স্যানিটাইস করলাম একবার ।বুঝলো মনে হয় লোকটা ।
হাউমাউ করে বললো ।
না না ।
আমার বউ , ওর মা , পোয়াতি ।
জিজ্ঞাসা করলাম শুয়ে কেন ? কদ্দিন ?
বললো চাঁদের হিসাবে সময় হয়েছে । আজ কালেই হবে হয়ত ।
– হাসপাতাল যাওনি ?
বললো এখন করুনার সময় আগে থেকে যেতে মানা করেছে দিদিমণি । ডেট হলে ওরা জানাবে বলেছে
কাল থেকে প্যাটে ব্যাথা খুব ।
সাহস করে সামনে গিয়ে বুঝলাম
আমারই অবস্থা
মা লক্ষির শরীরের ভান্ডার মেরেকেটে বিয়াল্লিশ কিলো হবে,বি এম আই দশের নীচে হবেই ।
পুঁচকা অবাক হয়ে তাকিয়ে..
বললাম কিরে মা কে ভালো করে খাওয়াস না কেন ?
নাক ঝেড়ে বললো
আব্বার কাম নাই , পুইসা নাই ঘরে ,
কিছুই বলার নাই । অস্বস্তি খানিকটা ।
তাও বললাম ,
জলসায় চিৎকার করছিলি কেন ?
বললো
ম্যায়ের প্যাটে দর্দ খুব..
আব্বা কখন গেছিল ফুঁকা পানি আনতে । দেরি করলো অনেক । মা কাঁদছিল ।
আবার অস্বস্তি । ওর বাবার দিকে তাকাতে বললো
কাম নাই , পুইসা নাই , ইবার জলসার চাঁদা দিতে পারি নাই ।
কুন মুখে ওয়াজ শেষের আগে পানিপড়া চাইবো বলেন ।
ছুয়াটা বুঝেই না ..
ছুয়ার চোখে বিশ্ব জয়ের হাসি । বললো আপনাকে দ্যাখেই আমি সাহস করে হুজুরের পায়ে পড়ে ফুঁকা পানি নিয়ে এসেছি । দু চামচি দিতেই প্যাট ব্যাথা ঠিক ।
দ্যাখেন মা কেমন ঘুমাচ্ছে ।
ঘোর চোখে বললাম চিন্তা করিস না । ঠিক হয়ে যাবে ।
চকচকে চোখ বললো
এখনো রেখে দিয়েছি হাফ গিলাস ।
হাসলাম একটু।
বেরোনোর সময় পুঁচকার বাপ বললো
কবে এ দুঃখু স্যাস হবে সার .. আর যে পারি না ।
ভেবেছিলাম বলবো পুঁচকার হোয়াটস আপে ক্লাস করেনা কেনর কথা ।
ভেবেছিলাম বলবো লক্ষির শরীরে ভিটামিন, ম্যাগনেশিয়াম আর ফলিক এসিডের কথা ।
ভেবেছিলাম বলবো রাখো কিছু টাকা ।
ভেবেছিলাম ..বলবো পানি পড়া আর ফুঁকা পানির কথা । ভেবেছিলাম বলবো পেন কিলারের কথা ।
বললাম কই । বলতে পারলাম কই ।
কাফের আমি
প্রথম বার মুখ দিয়ে বেরোলো
চিন্তা কোরো না ,
” আল্লাতালা সব দেখে রাহা হে…”
হিন্দি দিবস ছিল । তাই হিন্দিতেই ।
#সালা কাফের আমি ।
বললাম না
যাচ্ছেতাই ।