মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
সরু ফিতের মত পথ দিয়ে জিপটা এগোচ্ছিল। চিত্রে থেকে লামাধুরা হয়ে সান্দাকফুর কাছাকাছি আসতেই অনীশ জানালায় চোখ রেখে চমকে গেল। পাহাড়ের নীল নীল ছায়া পড়েছে উপত্যকায জুড়ে। তারমধ্যে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। লাল রডোডেনড্রনের জৌলুসে চোখ যেন ঝলসে যায়। পঁচিশ বছর পর এই দৃশ্যটা ফের দেখল অনীশ!
সান্দাকফু থানাযর ওসি চিনজু শেরপার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল। এক সময় এই থানার দায়িত্ব যে অনীশই সামলেছে এবং পুলিশের এক বড়কর্তা হয়ে মে সে অবসর নিয়েছে সেটা জানা ছিল চিনজুর। চিনজু জোর করে অনীশকে নিয়ে গেল নিজের ডেরায়। চিনজু ব্যাচেলর ছেলে, একাই থাকে। রান্না করার লোক বাজার থেকে মুরগির মাংস নিয়ে এল। সন্ধ্যে গাঢ় হলে চিনজূ বলল, ইয়ে,আপনার চলে তো স্যার? আমার স্টকে হুইস্কি আর রাম দুটোই আছে।
অনীশ শাল জড়িয়ে আরাম করে বসেছে। ইউনিফর্ম ছেড়ে এসেছে চিনজুও। টেবিলে চিকেন ফ্রাই, সোডা, জল আর হুইস্কি সাজানো। চিনজু বলল, স্যার, শুনেছি আপনার সময় কাঠের বাংলা ছিল এখানে। সেটা পুড়ে যাবার পর সে জায়গাতেই এই ইট-পাথরের কোয়ার্টারটা করা হয়েছে?
অনীশ গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিল, শিরীষ কাঠ দিয়ে তৈরি বাংলো ছিল। কালো শিরীষ নয়, সাদা শিরীষ। ফিকে বাদামি রং। ভিতরে সেগুন কাঠের ডেকোরেশন। পাহাড়ে আন্দোলনের সময় অ্যাক্টিভিস্টরা কাঠের বাংলোটা পুড়িয়ে দিয়েছিল।
চিনজু এক টুকরো চিকেন মুখে দিয়ে বলল, আপনি ম্যাডামকে নিয়ে এলে পারতেন স্যার। ওঁর ভালো লাগত।
অনীশ একটা শ্বাস গোপন করলো, সৌমনার ওভারিতে ম্যালিগন্যান্ট সিস্ট যখন ধরা পড়ল, তখন লাস্ট স্টেজ। মিসেস মারা যাবার পর তবুও অফিস-টফিস নিয়ে থাকতাম।
কিন্তু রিটায়ার করার পর সময় কাটানো একটা সমস্যা হয়েছে। একমাত্র মেয়ে থাকে বিদেশে। আমি বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে একেবারে একা।
- এখানে এসে ভাল করেছেন স্যার। দেখবেন, সান্দাকফুর প্রকৃতি আর পাখি আপনার মন ভালো করে দেবে।
- পাখির কথায় মনে পড়ল, তুমি গৌথালি পাখির নাম কখনো শুনেছ চিনজু?
- আমি এই পাহাড়ের ছেলে, গৌথালি পাখির কথা আমি জানি। খুব সুন্দর দেখতে ওরা। বাদামি রং, নীলয পুঁতির মতো চোখ, নাকটা সামান্য ভোঁতা।গৌথালি পাখির মৃত্যু নিয়ে একটা মিথ আছে। স্থানীয় লোকে বলে, এই পাখিরা নাকি বুঝতে পারে, কবে মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। তখন এরা বেনারসে উড়ে চলে যায়। মারা যায় সেখানে গিয়ে। ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্যের।
- আমার বাংলোতেও ভারী সুন্দর একটা গৌথালি বাসা বেঁধেছিল। যেদিন বাংলোটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়, সেদিন পাখিটা ঠায় বসেছিল। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বাসা ছেড়ে নড়েনি। নিজের মৃত্যু নিজেই রচনা করেছিল পাখিটা।
- চিনজু প্রসঙ্গ বদলাল। সান্দাকফুতে তো আপনার মেয়ের জন্ম তাই না?
- হ্যাঁ। সৌমনার প্রেগনেন্সি নিয়ে কম্প্লিকেসি ছিল। তিনবার মিসক্যারেজ হয়েছিল আগে। টুইটি হবার সময় শেষ ক’মাস নার্সিংহোমে একবারে বেড রেস্টে থেকেছিল সৌমনা । বাচ্চা হবার পর সৌমনা বেশ কিছুদিন হাঁটাচলা করতে পারেনি।
- তাহলে আপনার মেয়ের কে দেখভাল করতে সে সময়?
- একজন বেবিসিটার রাখা হয়েছিল। টুইটিকে রাখার পাশাপাশি সৌমনাকে ঘরকন্নায় সাহায্য করত মেয়েটা। ওর একটা ছেলে ছিল দু’বছরের। মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে কোমরে ঘুনসি পরা ফুটফুটে বাচ্চাটা আমার কোয়ার্টারে আসতো। কথায় কথায় ছেলেটা খিলখিল করে হাসত।
- সেই বেবিসিটারের নাম কি রিশাং শেরপা?
- অনীশ চিনজুকে জরিপ করছে চোখ সরু করে। বলল, তুমি চেনো ওকে? রিশাং সম্বন্ধে আর কিছু জানো?
ঘরের জানালা বন্ধ, তবুও ফাঁকফোকর দিয়ে ভেজা মেঘ আর কূয়াশা ঢুকে পড়ছে। দুজনের মধ্যে বুঝি সৃষ্টি করছে রহস্যময় আড়াল। চিনজুর মুখে অস্পষ্ট হাসি। দুটো খালি গ্লাসে সোনালী তরল ঢালতে ঢালতে বলল, জানি একটু-আধটু।
অনীশ অধৈর্য স্বরে বলল, মেয়েদের মত ন্যাকামো কোরো না। বলো কি জানো।
চিনজু গ্লাসটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বলল, রিশাঙয়ের বাড়ি ছিল মানেভঞ্জনে। বাপ-মা মরা মেয়ে, বর কেরল রাজ্যে দিনমজুর। রিশাঙের সঙ্গে আপনার একটা অ্যাফেয়ার তৈরি হয়েছিল। তার স্বামী বহুদিন পর বাড়িতে এসে জানতে পারে যে রিশাং প্রেগন্যান্ট। শুরু হয় অশান্তি। চলে বউয়ের উপর অত্যাচার। কাজ ছেড়ে দিতে বলে রিশাংকে। ওদিকে আপনার মিসেস তখনও হাঁটাচলা করতে পারেন না। ফলে আপনার মেয়ের মুখ চেয়ে রিশাং তখনো আসছিল কাজে।
অনীশ থম ধরে আছে। গলা খাকারি দিয়ে বলল, সৌমনার সঙ্গে আমার মেন্টালিটি ম্যাচ করেনি কোনদিনই। কিন্তু সৌমনার দোষগুণ বিচার করে আমি নিজে সাফাই গাইব না। বরং রিশাঙের কথা বলি। হাতির দাঁতের মতো গায়ের রং আর গৌথালি পাখিদের মত চিকন দুটো চোখ ছিল ওর। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি প্রেমে পড়েছিলাম রিশাঙয়ের। ইয়েস, উই হ্যাড সেক্স। তবে জোর করে কিছু হয়নি, যা হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়েছিল।
অনীশ টলছে একটু একটু। টয়লেট থেকে ঘুরে এল একবার। আগের কথার সূত্র ধরে বলল, রাশাং কয়েক মাস পিরিয়ড স্কিপ করেছিল। ওর স্বামী কেরল থেকে ফিরে এসে সেটা জানতে পারে। একদিন লোক জুটিয়ে আমার বাংলোতে আসে। মদ খেয়ে চুর ছিল প্রত্যেকে। প্রচন্ড হামলা শুরু করে। উত্তেজিত জনতা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় আমার বাংলো। আমি সার্ভিস রিভলবার থেকে ব্ল্যাংক ফায়ার করে ভিড় সরিয়ে পালাতে বাধ্য হই।
চিনজু আবার হুইস্কি ঢালল দুটো গ্লাসে। স্মিতমুখে বলল, যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা বলব স্যার? আমার মনে হয়, আপনার বাংলোতে কোনো গৌথালি পাখি কখনো বাসা বাঁধেনি। আপনি বানিয়ে বানিয়ে আমাকে গল্পটা শুনিয়েছেন।
অনীশ সবিস্ময়ে বলল, তোমার হঠাৎ একথা মনে হল কেন?
চিনজু হাসিটা ধরে রেখে বলল, গৌথালি পাখির সঙ্গে আপনার গভীর কোনো অনুভূতি জড়িয়ে আছে বলে। আপনার কনসাস মাইন্ড চায় সেটা গোপন করে রাখতে। সাবকনসাস মাইন্ড চায় সবাই আপনার প্রেমের কথা জানুক। সান্দাকফুতে এসে গৌথালি পাখি দেখে আপনি প্যাশনেট হয়েছিলেন। আমার গাট ফিলিং বলছে, আপনি রিশাংকে ভালোবেসে ‘গৌথালি’ নামে ডাকতেন।
হুইস্কির প্রভাবে অনীশের চোখ লালচে। জড়ানো গলায় বলল, ইউ হ্যাভ ভাস্ট পোটেনশিয়াল। তুমি অনেকদূর যাবে।
চিনজু ম্লান হাসল, তবে আপনার নামকরণ সার্থক। গৌথালি পাখিদের মতোই নিজের মৃত্যুর পূর্বাভাস ছিল রিশাঙের কাছে। আপনার বাংলো যখন জ্বলছিল, তখন কিন্তু সে আপনার মতো পালায়নি। স্থির দাঁড়িয়েছিল আগুনের মধ্যে। নিজের সম্মান, স্বামীর সম্মান রাখার জন্য এছাড়া হয়তো তার কাছে কোন পথ ছিল না। জানি না আপনি জানেন কিনা, পরদিন সকালে তার ছাই হয়ে যাওয়া দেহ উদ্ধার হয়েছিল পুড়ে যাওয়া বাংলোটা থেকে।
অনীশ গাঢ় স্বরে বলল, সান্দাকফু ছেড়ে চলে গেলেও সেখানকার সব খবর আমি আমার লোকদের কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছি। সেই ঘটনার এক মাসের মাথায় রিশাঙের স্বামী যে আবার বিয়ে করে সেটাও আমি জানি। কিন্তু গত পঁচিশ বছর আমি ভালো করে ঘুমাতে পর্যন্ত পারিনি। অনুতাপে পুড়েছি সবসময়। তুমি যদি ভেবে থাকো, এখানে একটি নিছক ছুটি কাটাতে এসেছি তাহলে তুমি ভুল ভাবছো।
- তবে কি জন্য এসেছেন?
- সৌমনা আমাকে ক্ষমা করেনি কোনদিন। টুইটিও বড় হবার পরে সৌমনার থেকে সব জেনেছে, শিখেছে আমাকে ঘৃণা করতে। আমার কথা ছাড়ো। কিন্তু এক গৌথালি পাখির সঙ্গে আমার অতীত যেমন মিশে আছে, তেমনি জড়িয়ে আছে আর-একজনের জীবনও।
নিরপরাধ এক শিশুর কাছ থেকে তার শৈশব কেড়ে নিয়েছিলাম তার মাকে ছিনিয়ে নিয়ে। আমার শোকের থেকে তার শোকের রঙ অনেক বেশি গাঢ়। আমি সান্দাকফু এসেছি তার কাছে ক্ষমা চাইতে। এসেছি পাশাপাশি বসে তার সঙ্গে একটুক্ষণ কাঁদব বলে।
- স্যার, আপনি কার কথা বলছেন?
- – রিশাং শেরপার ছেলের কথা বলছি । পঁচিশ বছর আগে কোমরে ঘুনসি পরা সেই ফুটফুটে বাচ্চাটার দু বছর বয়স ছিল।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে সময়ের মত। খালি হয়ে যাওয়া মদের গ্লাস হাতে দুই অসমবয়সী পুরুষ মুখোমুখি বসে আছে। মন খারাপ করা ভেজা বাষ্পের দল এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের। দুজনের মুখেই অব্যক্ত যন্ত্রণার ভাঙচুর। সময় যেন এক অতি দীর্ঘ রেলগাড়ি। দুজন অসুখী মানুষকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে মেঘ আর কুয়াশায় ঢাকা কোন নামহীন স্টেশনের দিকে।