সুস্থ থাকুন, জানুয়ারি২৫,২০২০:
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KANGAROO MOTHER CARE) : প্রকৃতির শিক্ষায় মানব শিশুর প্রাণরক্ষার আশ্চর্য পদ্ধতি
শ্যামশ্রী ব্যানার্জি, সিস্টার টিউটর, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ।
ছোট শিশুদের নিয়ে আমরা সবসময়ই চিন্তিত থাকি, আবার সেই শিশু যদি কম ওজনের হয় বা সময়ের আগে জন্মায় তাহলে এই চিন্তাটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আজ আমি এই ধরণের শিশুদের খুব সহজে যত্ন নেওয়ার একটি আশ্চর্য পদ্ধতি সম্পর্কে বলবো। পদ্ধতিটার নাম ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বা সংক্ষেপে KMC। এই পদ্ধতিটা সম্বন্ধে বলার আগে একটু ইতিহাসটা দেখে নিই। 1970 সালের শেষের দিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়ার একটা হাসপাতালে 70% কম ওজনের শিশুর মৃত্যু হতো। এদের মধ্যে বেশীর ভাগ শিশুরই মৃত্যু হয় শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ এবং নানারকম সংক্রমণে। বলে রাখা ভালো এইসব কম ওজনের শিশুদের রাখার জন্য যতগুলো Incubator যন্ত্র (শিশুকে গরম রাখার যন্ত্র) দরকার ছিলো তার থেকে অনেক কম Incubator ঐ হাসপাতালে ছিলো। তার ফলে বেশীরভাগ বেবীদেরই তাদের মায়ের সাথে রাখতে হয়। এবং এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায় যে সব মা তাদের বাচ্চাদের দিনের বেশীর ভাগ সময় একদম শরীরের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন সেইসব বাচ্চারা যে শুধু সুস্থ আছে তা নয় তাদের ওজনও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঘটনা থেকে এই KMC পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ঐ হাসপাতালের শিশুবিশেষজ্ঞ Edgar Rey । যদিও এই KMC নামটা তখন প্রচলিত ছিল না। প্রথমদিকে এটার নাম দেওয়া হয় ক্যাঙারু মাদার পদ্ধতি(1985)। পরে 1996সালে ইতালিতে একটা মিটিং এ 30 জন গবেষক, ডাঃ এড্রিয়ানো নামে একজন চিকিৎসক ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রতিনিধি মিলে এই পদ্ধতিটির নাম দেন ক্যাঙারু মাদার কেয়ার বা ক্যাঙারু মা পরিচর্যা। ক্যাঙারু মা পরিচর্যা বলতে আমরা বুঝি, বিশেষ উপায়ে কম ওজনের এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মানো নবজাতক শিশুর পরিচর্যার পদ্ধতি। নবজাতক যদি কোনো কারণে কম ওজনের হয় বা সে যদি একটু অসুস্থ থাকে, তাহলে মায়ের বুকে শিশুকে এমনভাবে শুইয়ে রাখতে হবে, যেন দুজনের ত্বকে ত্বক লেগে থাকে (Skin to skin)। এটাই ক্যাঙারু মা পরিচর্যা। নামটা এসেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী ক্যাঙারু থেকে। ওরা নিজের পেটের নীচে একটা বিশেষ থলিতে বাচ্চাদের নিয়ে চলাফেরা করে।
অপরিণত ও স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের নবজাতকের শরীরে এমনিতেই তাপমাত্রা কম থাকে। এতে এদের ঠাণ্ডা হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে অনেক বেশী। এই ক্যাঙ্গারু মা পদ্ধতিতে মায়ের শরীরের স্বাভাবিক তাপ নবজাতকের শরীরে প্রবাহিত হয়, ফলে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং মৃত্যুর ঝুঁকিও কমে। এছাড়াও মায়ের বুকের দুধপানও সহজ হয় এবং সন্তানের সাথে মায়ের বন্ধন দৃঢ় হয়। ক্যাঙারু মাদার কেয়ার পদ্ধতির দুটি মূল কথা:- ১) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এবং যত বেশীক্ষণ সময় পারা যায় ততক্ষণ শিশুকে মায়ের দুই স্তনের মাঝে ত্বকের স্পর্শে রাখতে হবে। ২)শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
প্রস্তুতি :-
যে কোনো মা এই পদ্ধতি অভ্যাস করতে পারেন। তাঁর বয়স, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, শিক্ষা এবং শিশুর সংখ্যা যাই হোক না কেন। এখানে মায়ের নিজের ইচ্ছাটাই শেষ কথা তবে, এই বিষয়ে মায়ের পাশাপাশি বাড়ীর অনান্য সদস্যদের ও আগ্রহটা খুব জরুরী। কারণ, সে মাকে উৎসাহ দিতে পারবে, গৃহস্হালীর কাজে মাকে সাহায্য করতে পারবে এবং প্রয়োজন হলে মায়ের পরিবর্তে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার অভ্যেস করতে পারবে। পরিবারের পাশাপাশি খুব কাছের আত্মীয় বা পাশাপাশি বাড়ীর লোকজনদেরও এই বিষয়ে জানাতে হবে তা না হলে মা সবার কাছে দর্শনীয় বস্তু হয়ে উঠবে যেটা মায়ের ইচ্ছাটাকে নষ্ট করে দিতে পারে। মায়ের পোষাক:- ঢিলে ঢালা, সুতীর পোষাক হলে খুবই ভালো। তবে, পোষাকটা এমন হবে যাতে মা শিশুকে বুকের মধ্যে ত্বকের স্পর্শে অনেকক্ষণ রাখতে পারে।। শিশুর পোষাক:- মাথায় টুপি,হাতে ও পায়ে মোজা, ন্যাপি ও বুকখোলা, হাতকাটা, ঢিলে ঢালা, সুতীর পোষাক হবে।। এছাড়া, মাকে প্রতিদিন স্নান করতে হবে। শাড়ী বা জামা (পোষাক) প্রতিদিন বদল করতে হবে। নখ ছোট করে কাটতে হবে এবং পরিষ্কার রাখতে হবে।।
পদ্ধতি :-
মায়ের অবস্থান – মা বিছানায় আধ শোওয়া (বালিশে হেলান দিয়ে) অবস্হায় বসে করতে পারে। আরাম কেদারা(Easy Chair) জাতীয় চেয়ারে বসে করতে পারে।
শিশুকে বন্ধনীর (Binder) সাহায্যে বুকের সাথে বেঁধেও অভ্যাস করতে পারে। শিশুর অবস্থান :-
শিশুকে মায়ের দুই স্তনের মাঝখানে ত্বকে ত্বক লাগিয়ে, মাথা উপরের দিকে করে সোজাসুজি শোওয়াতে হবে। শিশুর মাথাটিকে একদিকে ঘুরিয়ে রাখতে হবে এতে শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে সুবিধা হবে এবং মায়ের মুখ শিশুর দিকে থাকবে যাতে শিশু মায়ের সাথে চোখে চোখে কথা বলতে পারবে। শিশুর হাত এবং পা ব্যাঙের মতো ভাঁজ করে রাখতে হবে। শিশুর পেট মায়ের বুক ও পেটের মাঝখানে থাকবে।